পিতা-মাতার জন্য প্রতিটি সন্তানের পৃথিবীর মুখ দেখার সৌভাগ্য হয়ে ওঠে । যখন কান্না ছাড়া আমরা অন্য কোনো ভাষা জানতাম না, তখন একমাত্র মা-বাবাই আমাদের ভাষা বুঝে যেতেন। বুকে টেনে নিতেন, পরম যত্নে আগলে রাখেন। অসুস্থ হলে রাতদিন একাকার করে সেবা–শুশ্রূষা করেন। নিজে না খেয়ে সন্তানদের খাওয়ান। আদর যত্নে লালন-পালন করেন। সন্তানের সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। পিতা-মাতার অবদান পরিমাপ করা বা এর মূল্য নির্ণয় করা কোনো সন্তানের পক্ষেই পুরোপুরিভাবে কেন আংশিকভাবে সম্ভব নয়। সন্তানের জন্য পিতা–মাতা একমাত্র নিরাপদ স্থান।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, এই স্বর্গতুল্য পিতা-মাতা বার্ধক্যে উপনীত হলে আমাদের কাছে বোঝা মনে হয়। ঝামেলা মনে হয়।যার টাকা, পয়সা আছে বা জায়গা জমি আছে সে মায়ের দুঃখ কিছুটা হলেও কমে ।কিন্তু যার কিছু নেই তার ফল হিসেবে অনেক পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে জীবন কাটাতে হয়। অনেককেই ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন কাটাতে হয়। অথবা অনেককেই একাকী জীবন কাটাতে হয়। সন্তানেরা নতুন সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অনেকেই অতি–আধুনিকতাকে লালন করতে গিয়ে শহুরে জীবন বেছে নেন। কেউ কেউ আবার একক বা ক্ষুদ্র পরিবার গড়তে পিতা-মাতাকে দূরে ঠেলে দেন। পিতা-মাতার খোঁজ নেওয়ার এত টুকু সময় কারও নেই।
১৪ জুলাই-এর ঘটনা,আমরা বিভিন্ন খবরের কাগজে দেখলাম, ময়মনসিংহে ৭০ বছর বয়সের সালেমুন নেছা বৃষ্টিতে ভিজে ভিক্ষা করছেন। এমন একটি ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। অথচ ওনার সন্তান রয়েছে। ঢাকায় সেই সন্তানের সংসার রয়েছে। কিন্তু সে মায়ের খোঁজখবর রাখে না। সন্তান চাকরি করে, সেই খবরও মাকে জানায়নি। বাধ্য হয়েই মাকে ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিতে হয়েছে। ১০ বছর আগে তার স্বামী মারা যায় তখন থেকে সালেমুন নেছার জীবনযুদ্ধ শুরু হয়। তাদের সংসারে এক ছেলেসন্তান ছিল। স্বামীর অল্প কিছু জমি ছিল। ছেলে বড় হয়ে জমি বিক্রি করে অসহায় মাকে ছেড়ে ঢাকায় চলে যান। নিজের সন্তান কী করে মা আজও জানেন না। বৃদ্ধা মা কেমন আছেন তার খোঁজখবর নেন না একমাত্র সন্তান। দীর্ঘদিন সালেমুন নেছা খেয়ে না খেয়ে থেকেছেন। উপায় না পেয়ে দুমুঠো খাবার জোগাতে ভিক্ষার পথ বেছে নেন। মানুষের কাছ থেকে যা পান তা দিয়ে কোনো রকম খেয়ে দেয়ে বেঁচে আছেন তিনি। এখন বয়সের ভারে ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। তবুও প্রতিদিন রাস্তায় না নামলে তাঁর পেটে খাবার জোটে না। এ জন্য প্রতিদিনই তাকে ভিক্ষা করতে হয়।
একই দিনে আরেকটি খবর প্রকাশ হয়েছিল বিভিন্ন পত্রিকায়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় বৃদ্ধ পিতাকে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ফেলে গেছেন সন্তান। পরে সেখান থেকে পুলিশ উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করেছে। এখানেই শেষ নয়। এমন খবর হরহামেশাই শোনা যায়।
যারা আমাদের এই পৃথিবীতে এনে এর অফুরন্ত সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ করে দিল তাদের আমরা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিচ্ছি। খুব অসহায় অবস্থায় একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে। পৃথিবীতে এসে পিতা-মাতার যথাযথ লালন-পালন, আদর, স্নেহ, মমতা ও শিক্ষা-দীক্ষার মাঝে বেড়ে ওঠে সন্তান। আর সেই পিতা-মাতাকে ভরণপোষণ না দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তির পথে ঠেলে দিচ্ছি। রোগাক্রান্ত হলে সেবা যত্ন না করে রাস্তায় ফেলে যাচ্ছি। অনেক কুলাঙ্গার সন্তান রয়েছে যারা বাবা- মাকে মারধর পর্যন্তও করেন বলে শোনা যায়। একটি সমাজে যখন নীতি-নৈতিকতার চরম বিপর্যয় ঘটে তখন ফল হিসেবে পিতা-মাতাদের এমন করুণ পরিণতি পোহাতে হয়। আমাদের শিষ্টাচারিতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ যখন তলানিতে গিয়ে পৌঁছে তখন পিতা-মাতাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সেবাশুশ্রূষা প্রাপ্তির বদলে নিগৃহীত ও অত্যাচারিত হতে হয়।
এই নিকৃষ্ট কর্ম থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। পিতা-মাতার প্রতি হক আদায় করতে হবে। প্রত্যেক সন্তানের জন্য এটি পরম কর্তব্য এবং অবশ্য পালনীয়। পিতা-মাতার আদর যত্ন এবং সম্পত্তিতে সন্তানের যে রূপ অধিকার রয়েছে বার্ধক্যকালে সন্তানসন্ততি থেকে শ্রদ্ধা ও সেবাশুশ্রূষা পাওয়ারও সেইরূপ হক ও অধিকার পিতা-মাতার রয়েছে। বলা হয় মানব জাতি আজ উন্নতি আর সভ্যতার চরম শিখরে আরোহণ করেছে। পৃথিবী আজ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পথে হাঁটছে। কিন্তু তথাকথিত এই উন্নতি বা বিপ্লব আমাদের মন-মানসিকতার কতটা উন্নয়ন সাধন করতে পেরেছে? নাকি পৃথিবীর এই উন্নতি বা বিপ্লব আমাদের শুধুই যান্ত্রিকতা উপহার দিয়েছে? যেখানে দায়িত্ব বা কর্তব্যবোধ, কৃতজ্ঞতাবোধ এবং মায়া-মমতার বালাই নেই; রয়েছে শুধু দাম্ভিকতা, লোভ-লালসা এবং আত্মকেন্দ্রিক । জীবন সায়াহ্নে এসে যদি কোনো মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হয়, ভিক্ষাবৃত্তি করতে হয়, সামান্য সেবাশুশ্রূষা না পাওয়া যায় তাহলে আমাদের কথিত সকল সভ্যতা বা উন্নতি কার্যত ব্যর্থ।
প্রত্যেক সন্তানের উচিত মাতা-পিতার প্রতি তাদের যে কর্তব্য তা সঠিকভাবে পালন করা এবং সব সময় তাদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখা। পৃথিবীর সকল ধর্মেই পিতা-মাতাকে সম্মানের সর্বোচ্চ জায়গায় আসীন করা হয়েছে। আমাদের সকলকেই মনে রাখতে হবে অকালমৃত্যু না হলে একদিন আমরাও বার্ধক্যে উপনীত হব। পিতা-মাতার সঙ্গে যে রূপ আচরণ করব বার্ধক্যের সময় আমাদের সন্তানরাও সেইরূপ আচরণ আমাদের সঙ্গে করতে পারে।
সালেমুন নেছা’দের মতো অসহায় মায়েদের প্রতি রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব রয়েছে। একজন সন্তান কৃতজ্ঞতা ও কর্তব্যের মাথা খেয়ে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে দূরে ঠেলে দিতে পারে। কিন্তু একটি দেশের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্র তার মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন না। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা পাওয়া তাদের সাংবিধানিক অধিকার। রাষ্ট্রকে তাদের সেই অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে আইন করতে হবে কোনো সন্তান যেন পিতা-মাতাকে অবজ্ঞা করতে না পারে এবং বৃদ্ধ বা অসহায় পিতা-মাতাকে বাধ্যতামূলক ভরণপোষণের ব্যবস্থা করে।